লেখকঃ বখতিয়ার সালমান
মাঝেমধ্যে আমি একটু একা থাকতে পছন্দ করি। নিজের মতো করে সবকিছু ভাবতে, মনেমনে কথা বলতে, যে আনন্দ পাই তা আর কোথাও পাইনা। এই অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকেই। স্বভাবে খুব বেশি শান্তশিষ্ট নাহলেও তেমন উচ্ছৃঙ্খল ছিলামনা।
যাঁদের সাথে আমার বনিবনা হতো তাঁদের সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতাম। আর বাকীদের সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলতামনা। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব না থাকা সত্বেও পাড়ার অপছন্দনীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগুলোকে সালাম পর্যন্ত দিতামনা আমি। ইভেন এখনো এমন। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন আমি টিফিন সেরে ক্লাসের একপাশে জানালা ঘেঁষে বসে আছি। বন্ধুবান্ধব সবাই অন্যপাশে আড্ডা দিচ্ছে, পড়ছে, যে যার কাজে ব্যস্ত। শুধু আমিই একঘরে বৈচিত্র্যহীনের মতো বসে বসে ভাবছিলাম।
ছোটবেলায় যখন নানুবাড়িতে থাকতাম তখনকার সময়গুলো। আমার জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময়গুলো ওখানেই কেটেছিলো। বাড়ির খুব কাছেই নূরানি মাদ্রাসা। ওখান থেকেই আমার পড়ালেখার সূচনা। সেই সুবাদে আমার শৈশবের সিংহভাগ সময় নানুবাড়িতেই কেটেছিলো।
খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু ছিলো। তাঁদের কেউকেউ আমার মামাতো ভাই, খালাতো ভাই এমন। ছুটির দিনে কিংবা নানান উৎসবাদির সময় আরো দুয়েকজন যোগ হতো। বিশেষ করে তখনই আমরা পরিপূর্ণ ইবলিশ ছিলাম। আমাদের বাস ছিলো ঝোপে, ঝাড়ে, জঙ্গলে। বনের পশুপাখিরা আমাদের নিকটাত্মীয় ছিলো।
পরিবার আমাদের এসবের সতীন ছিলো। কিন্তু আমরা মন থেকে ভালো থাকতাম। খাবার সময় হলে আমাদের খোঁজে ক্লান্ত সবাই, কিন্তু আমরা খাবার পদ্ধতির এসব চিরায়ত প্রথাকে অস্বীকার করে নিজেদের মতো করে খেতাম, যখন যেমনটা মন চায়। এদিক-ওদিক থেকে এটা ওটা চুরি করে কিংবা কুড়িয়ে এনে বিলের মাঝে, জঙ্গলের ধারে নিজেরাই রান্না করে খেতাম। আমাদের রান্নার হাত ছিলো খুবই বাজে, কিন্তু স্বাদ ছিলো অমৃত।
বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ় মাসে আমাদের লাঞ্চ চিলো ফলপাকড়ের ভর্তা। দুপুরে সবাই ঘুমাতে যেতো। আমরা যেতাম আম,জাম,মুচি,বরই ইত্যাদি কুড়াতে। নানুদের বাসার পেছনে একটা পাকা বাথরুম ছিলো। আমরা চুপিচুপি তাঁর ছাদে বসে চাটনি বানিয়ে খেতাম। উপকরণ জোগাড়ে সবাই যারযার সাধ্যানুযায়ী সচেষ্ট ছিলাম।
আমি এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ লক্ষ করলাম সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, আবার মনে হচ্ছে ঠিক আমার দিকেও না। তাহলে কার দিকে? কেন? পেছনে ফিরে দেখি জানালার পাশে শান্তা। আমাকে ডাকছে। মনেহচ্ছে বেশ কয়েকবার ডেকেও ফেলেছে। আমি ভাবনার বিভোরে খেয়াল করিনি। অনাগ্রহের দৃষ্টিতে বললাম ‘কিছু বলবি?’।
-হ্যাঁ, কথা আছে তোর সাথে। ছুটির পরে বাইরে দাঁড়াস।
শান্তা আমাদের ক্লাসের সেই মেয়ে যাঁর রূপের দাপটে পুরো স্কুল কাঁপে। তাঁর দৃষ্টি যেদিকে যায় নূরের আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। মুখের বুলি শুনলে কুকিল পর্যন্ত লজ্জা পায়। যেই ছেলেটি ভাতের প্লেটে মায়ের একটা চুল পাওয়াতে না খেয়ে উঠে গিয়েছিলো সেই ছেলেটিও শান্তার পেছনে ঘুরে তাঁর মাথার উড়ন্ত চুলের ঘ্রাণ নিতে। ২৫ বছরের অভিজ্ঞ গণিতের শিক্ষকটি অংক ভুল করার কারণ হিসেবে শান্তার রূপকেই দায়ী করে থাকে শিক্ষার্থীরা।
শান্তার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের। স্কুলে তাঁর একমাত্র ছেলে বন্ধু আমিই। সেজন্য শান্তার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বদগুলো আমাকে হিংসে করে। আবার অনেকে আমাকে খুব ভালবাসে, আমি যদি দোকানে খেতে যাই তাঁরা বিল দেওয়ার জন্য প্রতিযোগীতায় নামে। আমার কোন হেল্প লাগলে বলার আগেই বুঝে ফেলে ওরা। এতটা খেয়াল রাখে আমার প্রতি।
এসব কেয়ার করার বিষয়ে আবার তারা শান্তার ধারেকাছেও আসার সাহস পায়না ওরা। শান্তা খুব মেজাজি স্বভাবের। পাত্তা দেয়না কোনো ছেলেকে। একদিন এক ছেলে তাঁকে চিটি লিখে প্রপোজ করেছিলো। শান্তা সরাসরি গিয়ে সেটা প্রধান শিক্ষকের কাছে দিয়ে স্কুলছাড়া করেছিলো ছেলেটিকে। তাছাড়া শিক্ষকরাও তাঁকে একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখেন। ব্যাপারটা স্যারকে না জানিয়ে যদি কিছু ছেলেকে জানাতো তাহলে ছেলেটিকে স্কুল না, দুনিয়া ছাড়া করতো।
কেউকেউ আমার কাছে এসে শান্তার খবর নেওয়ার চেষ্টা করে, শান্তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাঁদের দুর্বলতার কথা শেয়ার করে, কেউকেউ একটুখানি সুপারিশ করতে খুব রিকুয়েস্ট করে। এসব বিষয় প্রতিদিন ফেস করতে করতে তাঁদেরকে প্রবোধ দেওয়া আমার কাছে ইজি হয়ে গেছে এখন। যখন যাকে যেভাবে বলতে হয় বলে ম্যানেজ করে নিই। শান্তাও যথেষ্ট অবগত এ ব্যাপারে।
স্কুল ছুটি হলো,
আমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। কিছু ছেলে আমার চারপাশে এমনভাবে ঘিরে আছে যেন আমি দলনেতা আর ওরা আমার কর্মী। সবার চোখেমুখে কেবল আগ্রহ, শান্তাকে একনজর দেখার। এমন সময় শান্তা সিনেমার নায়িকার মতো বেরিয়ে আসছে ক্লাসরুম থেকে। তাঁর হাঁটার স্টাইল মানুষের স্বপ্নকেও হার মানাবে। পদধূলি যেন সোনায় পরিণত! তাঁর অবয়ব চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে মানুষের চোখকে। দুর্বল হার্টের মানুষ তার সামনে চলাফেরা করা বিপদজনক। সিগারেটের গায়ের মতো তাঁর গায়ে লিখে দেওয়া উচিৎ “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ শান্তা হৃদরোগের কারণ”। শ’খানেক ছেলের রাতের ঘুম হারাম নিশ্চিত করে সে আমার সামনে আসলো।
কথা বলতে বলতে হাঁটা শুরু করলাম দুজনে। অবাক হবার বিষয় যে শান্তা যখন আমার সাথে কথা বলে তখন মনেহয় যেন গ্রামের সহজ সরল বোকা টাইপের কোন মেয়ে। আমার নিজেরো চিনতে কষ্ট হয় তখন।
শান্তা বললো, আচ্ছা দোস্ত তুই তো প্রতিদিন আমার জন্য অনেক ঝামেলা পোহাস, তোর কি বিরক্ত করেনা?
এবার শক্ খেয়েছে শান্তা। কিঞ্চিৎ মন খারাপ করলো। কিছুটা রাগও করেছে।
রাগলে শান্তাকে চরম সুন্দর দেখায়। কিন্তু কেউ তাঁর চেহারার দিকে তাকায়না ভয়ে। আমার সাথে শান্তার আরেকটা আলাদা সম্পর্ক আছে। সেটা হলো শান্তা যখন রেগে যায় তখন আমি প্রচন্ড রকমের দুঃসাহসীর মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারি তাঁর চোখের দিকে, যা তাঁর রাগ ধ্বংস করার এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে।
শান্তা এবার একটু বেশিই রেগে গেলো।
পাশাপাশি থেকে ঘুরে দাঁড়ালো আমার সামনে। চোখে চোখ রাখলো। দুইহাত আমার কাঁধে। চোখ টলটল করছে রাগে। গদগদ আবেগ ভাসছে চেহারায়। আমি খুব স্বাভাবিক থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আর কোন কিছু না ভেবে একটু সামনের দিকে এগিয়ে তার কপালে চুমুটা দিয়ে ‘আই লাভ ইউ’ বলতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। 😰😰😰
লেখকঃ- সংবাদকর্মী ও সাহিত্যানুরাগী